Amazon.com বই এর স্টোর থেকে অর্ধশত পণ‍্য কিভাবে পৌঁছালো মানুষের দ্বারপ্রান্তে

Amazon.com বর্হিবিশ্বের গন্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও ই-কমার্সের বিশ্বস্ত স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। কাপড়, কসমেটিকস, ল‍্যাপটপ, কম্পিউটার, খাবার, বেবি টয় থেকে শুরু করে কি নেই এখানে। আপনার দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটি সব কিছুই আপনি পেয়ে যাচ্ছেন এই একটি মাত্র ওয়েবসাইট পেইজে অর্ডার করার মাধ্যমে। 

কিন্তু আপনি জানেন কি amazon শুরুর পেছনের গল্পটা কিন্তু এতটাও সাফল্যমন্ডিত ছিল না, যা আজকের বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে। Amazon.com শুরুর সেই ইতিহাস ও সাফল্যের গল্প সহ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ‍্য-ই আপনাকে দেবার চেষ্টা করছি। তাই মনোযোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন  । 

Amazon History in Bangla

Amazon.com এর যাত্রা শুরুর সাথে যেই মানুষটির অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিশেষ অবদান রয়েছে তিনি হচ্ছেন জেফ বেজোস। Amazon এর একমাত্র কো-ফাউন্ডার ও ব‍্যবস্থাপনা পরিচালক। জেফ বেজোস যিনি বতর্মানে সেরা দশ ধনীর তালিকার একজন। 

জেফ বেজোস ডি.ইশো এন্ড কো কোম্পানিতে ১৯৯৪ সালে চাকুরিকালীন অবস্থায় নতুন একটি প্রোজেক্ট-এর জন‍্যে ইন্টারনেটের বিভিন্ন বিষয়ে পরিসংখ্যান অনুসন্ধান করেন।

আর এই অনুসন্ধান এর প্রাক্কালেই তার নজর কাড়ে একটি চাঞ্চল্যকর তথ‍্য। তিনি দেখেন Worldwide web এর ব‍্যবহার প্রতিমাসে প্রায়ই তেইশ শতাংশ হারে বেড়েই চলেছে। ঠিক তখনই তার মাথায় অনলাইনে প্রডাক্ট বিক্রির সম্ভাবনাময় একটি ব‍্যবসার আইডিয়া ঘুরপাক খেতে থাকে। যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি লেগে পরেন তার সেই সম্ভাবনাময় ব‍্যবসাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন‍্যে। 

তিনি তার চাকুরী ছেড়ে দেবার সিদ্বান্ত নেন এবং তার এই সিদ্ধান্তের কথা “ডি ইশো এন্ড কো কোম্পানি-র” মালিক ডেভিডকে জানান। ডেভিড তাকে চাকুরীতে রাখার জন‍্যে নানা-ধরণের লং ওয়ার্ক প্রজেক্ট এর প্রস্তাব দিলেও তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও সরে আসেন নি। বরং মোটা অঙ্কের মাইনের লোভনীয় প্রস্তাবকে দূরে ঠেলে তিনি এবং তার একমাত্র সহধর্মিনী ম‍্যাকেনজি শুরু করেন তাদের নতুন ব‍্যবসা। শুরু হয় অক্লান্ত পরিশ্রম ও Amazon কে বিশ্বের একমাত্র ই-কমার্স সাইটে পরিণত করার যাত্রা। 

চাকরি ছাড়ার পর তিনি নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটল চলে যান। মূলত সিয়াটল এ থেকেই তিনি তার ই-কমার্স ব‍্যবসা পরিচালনা করার প্ল‍্যান করেছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটল এর প‍্রায় ২৯ শো মাইল পথের যাত্রায় তিনি ই-কমার্স সাইট পরিচালনার সমস্ত পরিকল্পনা সেরে ফেলেন। 

একই সাথে কি কি পণ‍্য তিনি তার ই-কমার্স সাইটটিতে রাখবেন তারও একটি লিস্ট করেন। অনলাইনে বিক্রির উপযোগী প্রায়-ই বিশ ধরণের প্রডাক্টের লিস্ট করেন যার মধ‍্যে সিডি, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়‍্যারসহ নানাধরণের পণ‍্য ছিল। 

তবে এইগুলোর মধ‍্যে থেকে তিনি বই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। মূলত Amazon কে তিনি অনলাইন বুক স্টোর হিসেবে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমটি ছিল ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি তার প্রচন্ড নেশা এবং দ্বিতীয়টি ছিল তৎকালীন আমেরিকান সরকার ক‍্যাটালগ অভ‍্যন্তরিত মেইল এর মাধ‍্যমে পণ‍্য বিক্রির উপর ট‍্যাক্স মওকুফ এর ঘোষণা দেন। ফলে জেফ যদি কোন পণ‍্য মেইলের মাধ‍্যমে তার ক্রেতাকে পাঠান তবে তাকে কোন টেক্স দিতে হচ্ছে না। ফলে জেফ এর ব‍্যবসায়িক খাত ও আরও একধাপ সামনে এগিয়ে গেলো। 

Amazon এর শুরু হয় তার সিয়েটল এর বাড়ির গ‍্যারেজ থেকে। আপনি হয়তো জেনে অবাক হবেন এতো কিছু পরিকল্পনা জেফ করে ফেলেছিলেন কোন ধরণের মূলধনের যোগান না করেই। তবে ভাগ‍্য এবারও তার সহায় ছিলেন বলতে পারেন। তিনি তার ই-কমার্স ব‍্যবসাটি পরিচালনার জন‍্যে পরিচিতদের কাছ থেকে ফান্ডিং করা শুরু করেন। কথায় আছে, একটি পুরুষের ধ্বংস ও সফলতা দুটোর পেছনেই নারীর হাত থাকে। তবে জেফ বেজোসের সহধর্মিণী যেন তার স্বপ্নের কান্ডারি হিসেবে-এই তার পেছনে সর্বদা ছায়া হয়েছিলেন। 

অনলাইন ভিক্তিক ই-কমার্স পরিচালনার জন‍্যে তার স্ত্রী ম‍্যাকেনজি একসময় ল‍্যাপটোপ, ফোন-কল ও মিটিং এর মাধ‍্যমে বিনিয়োগকারী খোঁজা শুরু করেন। Amazon এর ফান্ডিং এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন জেফ এর বাবা মাইক বেজোস এবং তার মা জ‍্যাকলিন বেজোস। তাদের বৃদ্ধবয়সের একমাত্র সম্বল ও পেনশনের প্রায় ৩ লাখ  ডলার তারা Amazon এ যোগ করেন। এবং অন‍্যান‍্য আত্বীয়স্বজনের কাছ থেকে বেজোস আরও ৭ লাখ ডলার মিলিয়ে প্রায়ই ১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে শুরু করেন আজকের সর্ববৃহৎ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান Amazon.com.  

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি বেজোসকে। তবে আজকের এই সর্ববৃহৎ Amazon.com এর নাম কিন্তু প্রথমে অ‍্যামাজন ছিল না। ১৯৯৪ সালের ৫ই জুলাই Amazon সর্বপ্রথম “ক‍্যাডাভ্রা” নামে বিশ্বের কাছে তার পরিচিতি তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে বাদ দেওয়া হয়। 

কেননা তার ব‍্যবসায়িক আইনজীবী তাকে এই নামের অর্থ জানান যা ছিল মরদেহ। এরপর তিনি তার প্রতিষ্ঠানের জন‍্যে একটি উপযোগী নাম খোঁজা শুরু করেন। পরপর কয়েকটি নাম তিনি ডোমেইন হিসেবে কিনলেও সেগুলো খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। 

এরপর একটি ডিকশনারি ঘাটতে গিয়ে Amazon নামটি তার চোখে পরে। নামটির প্রতি বিশেষ আর্কষণের অন‍্যতম কারণ হচ্ছে এর প্রথম অক্ষর “A” এবং চতুর্থ অক্ষরটি ছিল “Z”। আর তার ব‍্যবসায়িক পরিকল্পনাও ছিল মানুষের কাছে তার প্রয়োজনীয় এ টু জেড সবধরণের বই পৌঁছে দেওয়া। আর তাই Amazon এর নামের প্রথমে এ থেকে জেডের মধ‍্যে একটি দাগ দেখা যায়। 

অ‍্যামাজন ডট কম নাম হিসাবে পছন্দ করলেও জেফ ততদিনে “এ-ওয়ার্ক ডট.কম”,”ব্রা-উজ ডট.কম”, “বুক-মল ডট.কম” নামে কয়েকটি ডোমেইন তারা কিনে ফেলেছিলেন। 

জেফ বেজোস এবং তার স্ত্রী ম‍্যাকেনজি তাদের পুরো ঘরটিকে ব‍্যবসায়িক কাজে ব‍্যবহারের জন‍্যে উপযুক্ত করে তোলেন। এবং তাদের গ‍্যারেজকে গুদাম হিসেবে প্রস্তুত  করেন। 

জেইফের স্ত্রী অ‍্যামাজনের শুরুর দিকে একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। প্রথম অবস্থায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে অ‍্যামাজনের কর্মীদের মিটিং এর জন‍্যে কোন অফিস ছিল না। কর্মীদের মিটিং হতো “বানার্স অব নোবেল এর” বুক সেন্টারে। সাইট লঞ্চের পর সাইটকে বিভিন্ন প্লাটফর্মে টেস্ট করার জন‍্যে তারা প্রায় ৩০০ জন কর্মীকে প্রস্তুত করেন। 

১৯৯৫ সালে Amazon.com চালু হলে তারা এসব কর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যেতে বলেন। কোন একটি পণ‍্য বিক্রি হলে তা জানানোর জন‍্যেও বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এটি সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব হয় নি কারণ গত এক মাসের মধ‍্যে Amazon.com বিশ্বের ৫০ টি রাজ‍্যের ৪৫ টি দেশে ছড়িয়ে পরে। ওই একই বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের সাপ্তাহিক বিক্রির পরিমাণ গিয়ে দাড়া’য় প্রায়’ই বিশ হাজার ডলারে। 

অন‍্যদিকে ওই একি বছরেই “ক্লেনের-পার্কিনস-কোও ফি’ল এন্ড বায়ার্সে’র” একটি কোম্পানি Amazon এ আট মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। কিন্তু তখনও amazon অনলাইনে স্টোরের জন‍্যে পরিপূর্ণ ছিল না কারণ তখন বেশিরভাগ পণ‍্য ই ফেইস-টু-ফেইস বিক্রি হতো। 

এছাড়াও তিনি নতুন জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন কেননা এসময় Amazon এর কর্মীদের সপ্তাহে ৬০ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে হতো। এজন‍্যে জোফ বেজোস Amazon কে একটি আইপি-ওর এর মাধ্যমে সবার সামনে আনার পরিকল্পনা করেন। 

এর মধ‍্যে ছিলেন কিছু ডেস্কো কর্মকর্তা, বার্নোস এন্ড নবেলে থেকে কার্যনির্বাহী, সফটওয়্যার এন্ড সিমেন্টেক থেকে কর্মকর্তা, মাইক্রোসফট কোম্পানি থেকে দু’জন প্রকৌশলীদের সহ-সভাপতি হিসেবে জোয়েফ পিজি.এস এবং ডেভিড রিশার কে নিযুক্ত করেন । এর মধ‍্যে ডেভিড রিশার বিক্রয় কোম্পানির প্রধান হয়েছিলেন। এরকম একটি দুর্দান্ত টিম নিয়েই Amazon তার সাফল‍্যের সিড়ি উন্মোচনের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। এই টিমের একটি বিশেষ নামও তিনি দেন “জে-টিম “। 

এবং এই টিম টিই Amazon কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৯৭ সাল ছিল Amazon এর জন‍্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছর Amazon এর প্রায় তিন লাখ শেয়ার বাজারে আটকা পরে। ক্ষতি লাঘব করতে এবছর Amazon দুইমাসের জন‍্যে পাবলিক ফান্ড ওপেন করেন। এরপর জেফ বেজোস এবার সফলভাবে ফান্ডিং করে। 

ওই বছর Amazon এ তিনি বড়দিন উপলক্ষ্যে সাময়িকভাবে গিফট ও খেলনা কেনার সুবিধা যোগ করেন। সাথে সাথে অনলাইন রিটেইলারদের কমিশনের ব‍্যবস্থা করেন। 

এবছর Amazon প্লানেটলবুকপেস্টসহ দুটি কোম্পানি অধিক গ্রহণ করেন। এর পরবর্তীতে এর সংখ‍্যা দাড়ায় ৪৪ টিতে। 

বার্নেস ও নোবেলের পর Ebay এর নতুন প্রতিযোগী এ বছর ই বাজারে আসে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে Amazon এর ১৫০ বিলিয়ন মূল‍্যের ঔষধ বাজারে আসে। ২০০৩ সালের দিকে প্রায় তিন-শো হাজার ব্রান্ড এর সাথে যুক্ত হয়। সেবছর Amazon A9 চালু করেন। A9 মূলত একটি ই-কমার্স ভিক্তিক বাণিজ্যিক সার্চ ইঞ্জিন। এই কয়েক বছরে Amazon জার্মান, ইটালি, ফ্রান্স প্রভৃতিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পরে। 

Amazon.Com এর সাফল‍্যের পেছনে রয়েছে জেফ বেজোস এর সফল নেতৃত্ব। তিনি Amazon এর কর্মী নিয়োগের ব‍্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেন। তিনি ইন্টারভিউ বোর্ডে নিজে উপস্থিত থাকেন। এবং তিনি চান তার নতুন নিয়োগকৃত কর্মীরা যাতে আগের চেয়ে বেশি কর্মদক্ষ থাকেন। 

সফলতার মূলমন্ত্র-ই হচ্ছে সঠিক নেতৃত্ব যা জেফ বেজোসের মতো একজন সফল উদোক্তার মাধ‍্যমে ই সম্ভব। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২১ মোট ২৩ বছরে Amazon.com এর সফল পথচলা ও তার সাফল‍্যকে ধরে রাখা সত‍্যিই খুব চমকপ্রদ। শুধুমাত্র ফান্ডিং এর মাধ্যমে এতো এতো প্রশংসা কুড়ানোর পেছনে যেই কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন সত্যি ই তা অভাবনীয়। 

তাই ধরে রাখুন মনের জোর আর প্রফিট মার্জিন ঠিক রেখে যদি ব‍্যবসা করেন তবে আপনিও হতে পারেন Amazon.com এর মতো সফল কোন প্রতিষ্ঠানের উদ‍্যোক্তা।

Share this article
Shareable URL
Next Post

Top 3 Alternatives to Leonardo AI for Creating AI Images

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *